কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তার বাংলাদেশে জীবনযাত্রাকে অনেকাংশে সহজ করলেও, এর অপব্যবহার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতার একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, নারী নেত্রী, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে এআই-এর মাধ্যমে ভুয়া ছবি, ভিডিও এবং অপতথ্য ছড়ানোর ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব এবং আইনি কাঠামোর ঘাটতির কারণে এই অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, যা আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
#### নারীদের প্রতি ডিজিটাল হয়রানি ও এআই প্রযুক্তি
নারীরা, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেত্রীরা, এআই প্রযুক্তির অপব্যবহারের সবচেয়ে বড় শিকার। এআই-এর মাধ্যমে তৈরি শ্লীলতাহানিমূলক, বিভ্রান্তিকর এবং মানহানিকর কনটেন্ট নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করছে। একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ৬৮% নারী অনলাইনে এ ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ৭৫% ক্ষেত্রে এআই-এর মাধ্যমে তৈরি অশ্লীল ছবি ও ভিডিও জড়িত। এসব কনটেন্ট শুধু ব্যক্তিগত নিরাপত্তাই নয়, সমাজে বিভাজন ও অস্থিরতাও বাড়াচ্ছে।
#### জাতীয় দুর্যোগে বিভ্রান্তি ছড়ানো
গত ২১ জুলাই ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দেশবাসী শোকাহত ছিল। কিন্তু এই সংকটের মধ্যেই এআই-এর মাধ্যমে তৈরি ভুয়া ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা তথ্য যাচাইকরণ কেন্দ্র এই ভিডিওগুলোকে এআই-চালিত কল্পিত দৃশ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যেখানে ভুল তথ্য, ভবনের ভিন্ন গঠন এবং ভাষাগত ত্রুটি ছিল। এই ঘটনা জাতীয় শোকের সময় এআই অপব্যবহারের ভয়াবহতার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
#### প্রশাসনিক ও আইনি দুর্বলতা
সরকার এআই অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মাহমুদ হাসান বলেন, “সাইবার নিরাপত্তা আইনে এআই অপব্যবহার রোধে বিধান রয়েছে, কিন্তু আইন প্রয়োগে ঘাটতি এবং জনগণের ডিজিটাল সচেতনতার অভাব এটিকে জটিল করে তুলেছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, “বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এআই অপব্যবহার রোধে প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। বাংলাদেশেও এখনই নজরদারি টিম গঠন, নীতিনির্ধারকদের সক্রিয় ভূমিকা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।”
লন্ডনভিত্তিক প্রযুক্তি বিশ্লেষক রেহান আলী মনে করেন, “সোশ্যাল মিডিয়ায় এআই-চালিত অপতথ্যের বিস্তার ভয়াবহ হারে বাড়ছে। নারীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সহিংসতা রোধে আইনি কাঠামো, তথ্য যাচাই প্ল্যাটফর্ম এবং মিডিয়া সাক্ষরতা বৃদ্ধি অপরিহার্য।”
#### সোশ্যাল মিডিয়ায় এআই-চালিত অপতথ্যের বিস্তার
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং এক্স-এর মতো প্ল্যাটফর্মে ৮৫% পোস্ট এআই রিকমেন্ডেশনের মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। গত ছয় মাসে ভুল তথ্য ছড়ানোর হার প্রায় ২৫০ গুণ বেড়েছে, যা রাজনৈতিক দল ও নেতাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং সামাজিক বিভাজনকে আরও তীব্র করছে। ডিপফেক, সিন্থেটিক ভিডিও এবং ভয়েস ক্লোনিং প্রযুক্তির সহজলভ্যতা সাধারণ মানুষকেও বাস্তবসদৃশ ভুয়া কনটেন্ট তৈরির সুযোগ দিচ্ছে। প্রযুক্তিবিদরা আশঙ্কা করছেন, নির্বাচনের আগে এ ধরনের কনটেন্ট ডিজিটাল সহিংসতা ও অপপ্রচারকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলবে।
#### আইনি ও নীতিগত শূন্যতা
বাংলাদেশে এআই অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কোনো নির্দিষ্ট আইন বা নীতিমালা নেই। তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, এআই-চালিত ভুয়া কনটেন্টকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা, ডিপফেক শনাক্তকরণে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সোশ্যাল মিডিয়া নজরদারির জন্য বিশেষ টিম গঠন জরুরি।
অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, “অপতথ্য নিয়ন্ত্রণে নজরদারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশনের উচিত বিশেষ টিম গঠন করে কনটেন্ট পর্যবেক্ষণ করা।”
রেহান আলী যোগ করেন, “ফেসবুক, এক্স এবং ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে এআই কনটেন্টের বিস্তার থামাতে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ এবং প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে সরকারি সমন্বয় প্রয়োজন।”
#### ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ ও সমাধান
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এআই প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকগুলোর পাশাপাশি এর অপব্যবহার রোধে বহুমুখী পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে:
- কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ
- উন্নত তথ্য যাচাই ও ডিপফেক শনাক্তকরণ প্রযুক্তি চালু
- প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে নজরদারি টিম গঠন
- জনগণের ডিজিটাল ও মিডিয়া সাক্ষরতা বৃদ্ধি
- সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে কার্যকর সমন্বয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক সতর্ক করে বলেন, “নির্বাচনের আগে এআই-চালিত অপতথ্যের বৃদ্ধি দেশকে একটি কঠিন সংকটের মুখে ঠেলে দিতে পারে। এখনই সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।”
#### উপসংহার
বাংলাদেশে এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার একটি ভয়াবহ সংকটে রূপ নিচ্ছে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং মানবাধিকারের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ এবং জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা ছাড়া এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। অন্যথায়, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন এবং দেশের ভবিষ্যৎ প্রভাবিত হওয়ার পাশাপাশি ডিজিটাল জগতে একটি গভীর সংকটের আশঙ্কা বেড়ে যাবে।